মহাবিশ্বের সবকিছু একদিন ধ্বংস হয়ে যাবে। ইসলামি আকিদা অনুসাররে ফেরেশতা ইসরাফিল (আ.)-এর শিঙ্গায় ফুঁ দেওয়ার মাধ্যমে কেয়ামত শুরু হবে। বিশুদ্ধ বর্ণনামতে, ইসরাফিল (আ.) শিঙ্গায় দু’বার ফুঁ দেবেন। (সুরা জুমার: ৬৮)
প্রথম ফুঁৎকারে আকাশ ফেটে যাবে, তারকাসমূহ খসে পড়বে, পাহাড়-পর্বত ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে তুলার মত উড়তে থাকবে। সকল মানুষ ও জীব-জন্তু মরে যাবে, আকাশ ও সমগ্র পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। সেদিন নারীরা দুগ্ধপোষ্য শিশুকে ভুলে যাবে এবং গর্ভধারিণী তার গর্ভপাত করে ফেলবে, মানুষকে মাতালের মতো দেখাবে, অথচ তারা মাতাল নয়। দ্বিতীয় ফুঁৎকার দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবী সৃষ্টির পর থেকে যত জীবের সৃষ্টি হয়েছিল, তারা সকলেই জীবিত হয়ে উঠে দাঁড়াবে। হাশরের জন্য সর্বপ্রথম যার কবর খুলে দেওয়া হবে তিনি হলেন মহানবী (স.)। তিনি ইরশাদ করেন,, ‘দ্বিতীয়বার শিঙ্গায় ফুঁৎকার দেওয়ার পর সর্বপ্রথম আমি মাথা তুলব। তখন আমি দেখব, মুসা (আ.) আরশের এক পায়া ধরে আছেন। আমি জানব না, তিনি এভাবেই ছিলেন নাকি দ্বিতীয়বার শিঙ্গায় ফুঁ দেওয়ার পর সেখানে গিয়েছেন।’ (সুরা হজ: ২; বুখারি: ৪৮১৩)
সেদিন জমিন পরিবর্তিত হয়ে অন্য জমিন হবে, সেদিন ময়দার রুটির মতো সাদা পরিষ্কার ও মসৃণ জমিনের বুকে মানবজাতিকে পুনরুত্থিত করা হবে। এতে কোনো চিহ্ন (ঘর, উদ্যান, গাছ, পাহাড়, টিলা ইত্যাদি) থাকবে না। সেদিন সৃষ্টিকর্তার সামনে সব আওয়াজ স্তব্ধ হয়ে যাবে, চেহারাগুলো অবনত থাকবে এবং সব সৃষ্টিই মহাপ্রতাপশালী আল্লাহর সামনে আত্মসমর্পণ করবে; তখন চলাচলকারীদের পায়ের মৃদু আওয়াজ ও হালকা শব্দ ছাড়া কিছুই শোনা যাবে না। মহান আল্লাহ বলেন, ‘যেদিন এই পৃথিবী পরিবর্তিত হয়ে অন্য পৃথিবী হবে এবং আকাশও (পরিবর্তিত হবে) আর মানুষ উপস্থিত হবে আল্লাহর সামনে—যিনি এক, পরাক্রমশালী।’ (সুরা ইবরাহিম: ৪৮)
কিয়ামতের দিনটি প্রচণ্ড উত্তপ্ত থাকবে। মহানবী (স.) ইরশাদ করেছেন, ‘বিচার দিবসে সূর্যকে মানুষের কাছে আনা হবে, তা হবে তাদের থেকে এক ফরসাখ (তিন মাইল) দূরে। ব্যক্তির আমল অনুযায়ী ঘামের মধ্যে অবস্থান করবে। কারো ঘাম হবে টাখনু সমান, কারো হাঁটু সমান, কারো কোমর সমান, কারো মুখ সমান (মেশকাত, পৃষ্ঠা-৪৮৩)
সেদিন সমগ্র মানবজাতির হিসাব নেওয়া হবে। হিসাব নেওয়া হবে জিন, পশুপাখিসহ সবকিছুর। এতসব কিছুর বিশাল হিসাব-বিচার মাত্র এক দিনে শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু সেই এক দিন হবে অনেক দীর্ঘ। দুনিয়ার এক হাজার বছরের সমান (সুরা হজ: ৪৭) অথবা কারো কারো ক্ষেত্রে ‘দিনটা হবে ৫০ হাজার বছরের সমান।’ (সুরা মাআরিজ: ৪)
তবে মুমিনের জন্য দিনটি হবে একেবারে অল্প সময়ের। আবু সাঈদ খুদরি (রা.) বর্ণনা করেন, সাহাবায়ে কেরাম রাসুল (স.)-কে এই দিনের দীর্ঘতা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, আমার প্রাণ যে সত্তার করায়ত্ত, তাঁর শপথ করে বলছি— এই দিনটি মুমিনের জন্য একটি ফরজ নামাজ পড়ার সময়ের চেয়েও কম হবে।’ ইমাম বায়হাকিও ইমাম হাকেম হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণনা করেছেন, মুমিনদের জন্য দিনটি হবে জোহর ও আসর নামাজের মধ্যবর্তী সময় পরিমাণ।’ (তাফসিরে মাজহারি: ১০/৬২)
হাশরের মাঠে তিনটা কঠিন মুহূর্তে কেউ কাউকে স্মরণ করবে না। রাসুল (স.) বলেন, হে আয়েশা, জেনে রাখো, তিনটি জায়গা এমন হবে যেখানে কেউ কাউকে স্মরণ করবে না- ১. মিজানের কাছে যতক্ষণ না সে জেনে নেবে যে, তার আমলের পাল্লা ভারী রয়েছে নাকি হালকা? ২. আমলনামা পাওয়ার সময়, যখন তাকে বলা হবে, আরে অমুক! এই নাও তোমার আমলনামা এবং তা পড়ে দেখো। যে পর্যন্ত না সে জেনে নেবে যে, তা তাকে ডান হাতে দেওয়া হয়েছে নাকি পেছন থেকে বাম হাতে দেওয়ার দ্বারা ভয়ঙ্কর আজাব দেওয়া হবে? এবং ৩. পুলসিরাত যখন তা লোকের ধন-সম্পদকে বেড়ি বানানো হবে জাহান্নামের ওপর স্থাপন করা হবে। (আবু দাউদ: ৪৭৫৫)
হাশরের দিনের এমন কঠিন অবস্থায় তিন জায়গায় নবীজির আনাগোনা থাকবে। পুলসিরাতের কাছে, মিজানের কাছে এবং হাউজে কাউসারের কাছে। (জামে তিরমিজি: ২৪৩৩; মুসনাদে আহমদ: ১২৮২৫)
হাশরের ময়দানে একটু সুপারিশের জন্য সবাই একে অন্যের কাছে ঘুরবে। হাদিস শরিফে এসেছে, ‘হাশরের ময়দানে মানুষ হজরত আদম (আ.)-এর কাছে গিয়ে বলবে, আপনার সন্তানদের জন্য সুপারিশ করুন, তিনি তখন বলবেন, আমি এর যোগ্য নই, তোমরা ইবরাহিম (আ.)-এর কাছে যাও, কারণ তিনি আল্লাহর বন্ধু। অতঃপর মানুষ ইবরাহিম (আ.)-এর কাছে আসবে। তিনি তখন বলবেন, আমি এর যোগ্য নই, বরং তোমরা মুসা (আ.)-এর কাছে যাও। কারণ তিনি কালিমাতুল্লাহ তথা আল্লাহর সঙ্গে কথা বলেছেন। অতঃপর তারা মুসা (আ.)-এর কাছে আসবে। তিনি বলবেন, আমি এর যোগ্য নই, বরং তোমরা ঈসা (আ.)-এর কাছে যাও। কারণ তিনি রুহুল্লাহ। অতঃপর মানুষ তাঁর কাছে আসবে। তিনি তখন বলবেন, আমি এর যোগ্য নই, বরং তোমরা মুহাম্মদ (স.)-এর কাছে যাও। অতঃপর মানুষ তাঁর কাছে আসবে, তিনি তখন বলবেন, হ্যাঁ, আমি এর যোগ্য, আমি সুপারিশ করব।’ (কুরতুবি, ১০ম খণ্ড, ২৩৬ পৃষ্ঠা)
নবীজিই প্রথম আল্লাহর কাছে মিনতি করে সুপারিশ করার অনুমতি আনবেন। নবীজি (স.) বলেন, আমি তখন আল্লাহর আরশের নিচে এসে সেজদায় পড়ে কান্নাকাটি করতে থাকব। (আল্লাহ যেন আমাকে সুপারিশ করার অনুমতি দেন)। অতঃপর আল্লাহর তরফ থেকে বলা হবে, আপনি মাথা উঠান। আপনার প্রার্থনা কবুল করা হবে। রাসুল (সা.) মাথা উঠাবেন এবং বলবেন, হে আমার রব, আপনি আমার উম্মতকে ক্ষমা করুন। আল্লাহ তায়ালা বলবেন, হে আমার প্রিয়নবী, আমার নিরপরাধ বান্দাদের বেহেশতের ডানদিকের দরজা দিয়ে প্রবেশ করান। অন্য দরজা দিয়েও ইচ্ছা করলে প্রবেশ করাতে পারেন। (বুখারি : ৪৭১২)
অতএব, মহাবিচারের কঠিন দিনটির কথা স্মরণ করে মুসলিম উম্মাহর উচিত হবে- আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের আদেশ-নিষেধ মেনে চলা। নবীজির সুপারিশ লাভ করার জন্য সুন্নতের ওপর জীবন পরিচালনা করা। অন্যথায় আল্লাহর রহমত এবং নবীজির সুপারিশ পাওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘তারা শুধু এই অপেক্ষাই করছে যে কেয়ামত অকস্মাৎ তাদের কাছে এসে পড়ুক। বস্তুত কেয়ামতের লক্ষণসমূহ তো এসেই পড়েছে। সুতরাং কেয়ামত এসে পড়লে তারা উপদেশ গ্রহণ করবে কেমন করে?’ (সুরা মুহাম্মদ: ১৮) আরও ইরশাদ হয়েছে, ‘মানুষের হিসাব-নিকাশের সময় আসন্ন, কিন্তু তারা উদাসীনতায় মুখ ফিরিয়ে আছে।’ (সুরা আম্বিয়া: ১)
আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে উদাসীন হওয়া থেকে হেফাজত করুন। মৃত্যুর আগে নিজের আমলনামাকে সুন্দর করার তাওফিক দান করুন। আমিন।