কাজী মোস্তফা রুমি বিশেষ প্রতিনিধি
একটি পত্রিকার ১৬ জন সাংবাদিক। যাদের সকলেই শ্রমিক বা দিন-মজুর। কেউ ইটভাটা শ্রমিক, কেউ কৃষিজীবী, কেউ মৎসজীবী। আছেন নারী, এমনকি প্রতিবন্ধীও। অবাক করার বিষয় হল, পত্রিকাটির সম্পাদকও একজন ইটভাটার শ্রমিক। বলছি উপকূলীয় কমিউনিটি পত্রিকা আন্ধারমানিকের কথা, যেখানে প্রকাশ পায় গ্রামের খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের সুখ দুঃখের গল্প।
পটুয়াখালীর কলাপাড়া থানার নীলগঞ্জ ইউনিয়নের পশ্চিম সোনাতলা গ্রাম থেকে প্রকাশ হওয়া পত্রিকাটি যাত্রা শুরু করে ২০১৯ সালের ১ মে। সম্পাদকের দায়িত্বে আছেন পশ্চিম সোনাতলা গ্রামের সন্তান হাসান পারভেজ। দুই মেয়ে এবং স্ত্রীকে নিয়ে থাকেন একটা ছোট্ট ঘরে। কিন্তু যেই ভিটেতে তার ঘর সেই ভিটেও তার নয়। অর্থাৎ অন্যের জায়গায় ঘর করে আছেন তিনি। জায়গার মালিক প্রয়োজনে জায়গাটা বিক্রি করে দেবেন বলে হাসানকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। হাসানের ভাষ্যমতে, তার টাকা না থাকায় হয়ত খুব শিগগিরই তাকে পশ্চিম সোনাতলা গ্রাম ছেড়ে পাড়ি দিতে হবে অন্য কোন গ্রামে। কিন্তু যার সাংসারিক অবস্থার এমন হাল তিনিই কিনা নিছকই শখের বসে একটা পত্রিকার দায়িত্ব তুলে নিয়েছেন নিজের কাঁধে।
হাসান পারভেজ জানান, অনেক আগে থেকেই গল্প, কবিতা লিখতেন তিনি। কিন্তু কোন দিন কোন পত্রিকায় প্রকাশ না পাওয়ায় মন খারাপ থাকতো। হঠাৎ একদিন উপকূল সাংবাদিক রফিকুল ইসলাম মন্টুর সাথে দেখা হলে তাঁর কাছে বিষয়টা খুলে বলেন। তিনি একটা কমিউনিটি পত্রিকা খোলার পরামর্শ দিলেন। গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলা নদীর নামানুসারে পত্রিকার নাম রাখা হয় আন্ধারমানিক। আন্ধারমানিক পত্রিকার শুরু থেকেই গ্রামের সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের সুখ দুঃখের গল্প প্রকাশ পাওয়ায় মানুষের মনে জায়গা করে নিতে সময় লাগেনি আন্ধারমানিকের।
এই পত্রিকায় স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে সাংবাদ প্রতিনিধি হিসেবে যারা কাজ করছেন তাদের প্রায় সবাই শ্রমজীবী মানুষ। তারা যখন অন্যের বাড়িতে শ্রম বিক্রি করতে যান, তখন গ্রামের বিভিন্ন মানুষের সুখ দুঃখের গল্প শুনে সেগুলোই লিখে পাঠান আন্ধারমানিকের সম্পাদক হাসান পারভেজের কাছে। হাসান পারভেজ দিনে শ্রমিকের কাজ শেষ করে সন্ধ্যা কিংবা রাতে যতটুকু সময় পান, সেই সময়টুকু কাজে লাগান পত্রিকার প্রতিনিধিদের পাঠানো লেখাগুলোকে পত্রিকার পাতায় লেখার কাজে। খবরের শিরোনাম গুলো শুধু ছাপার হরফে করা হয় আর বাকি অংশটা হয় হাতের লেখায়। তারপর হাতে লেখা কপিটা স্থানীয় ফটোকপির দোকানে গিয়ে প্রয়োজন অনুযায়ী নির্দিষ্ট সংখ্যক কপি প্রকাশ করা হয়। মাস শেষে প্রকাশ হওয়া পত্রিকার কপিগুলো প্রতিনিধি এবং সম্পাদক হাসান পারভেজের মাধ্যমে পৌছে যায় মানুষের হাতে হাতে।
‘তাল রসের গুড় করে সংসার চালান ইব্রাহীম হাজারী’, ‘সফল চাষী রশিদ মাঝি’, ‘শারীরিক ভাবে অসুস্থ নাছিমা পাগলী’, এবং ‘স্বামী পরিত্যক্তা দুই বোবা মেয়ে’কে নিয়ে অভাব সাগরে ভাসছেন বিধবা চানবরু’— এমন শিরোনামে প্রকাশ পাওয়া গল্পগুলো পড়ে মানুষ একদিকে যেমন বিভিন্ন কাজে উদ্যমী হন তেমনি অসহায় মানুষের খবরে এগিয়ে এসে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন অনেক হৃদয়বান ব্যক্তি।
হাসান পারভেজ বলেন, ‘উপজেলা নির্বাহী অফিসার স্যার আমাকে একটা ঘর দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু আমি নেইনি। বলেছি, আমার কোন মত মাথা গোঁজার ঠাই একটা ঘর অন্তত আছে কিন্তু যার একদমই নেই এমন কেউ থাকলে তাকেই দিন।’ তিনি আরও বলেন, আমি আগে অর্থের অভাবে তিনবেলা খেতে পারতাম না, এমনকি কোন কোন দিন না খেয়েও থাকতে হতো। এখনতো আল্লাহর রহমতে তিন বেলায় খাবার খাই। আমি চাই, এই পত্রিকা যেন আমি না থাকলেও থাকে, সাধারণ মানুষের কথা তুলে ধরতে পারে সেটার একটা নিশ্চিত ব্যবস্থা হোক। গ্রামের মানুষের অসহায় চিত্র দেখে সমাজের বিত্তবানরাও যেন পাশে এসে দাঁড়ান। ‘