রাষ্ট্র সংস্কারে ১০ দফায় ৮১টি প্রস্তাবনা দিয়েছে জামায়াতে ইসলামী। দলটি বিদ্যমান সংসদীয় আসন পদ্ধতির পরিবর্তে ভোটের অনুপাতে প্রতিনিধিত্বশীল পদ্ধতিতে সংসদ নির্বাচনের প্রস্তাব করেছে।
স্থায়ীভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহাল, প্রধানমন্ত্রীর পদ পরপর দুই মেয়াদে সীমাবদ্ধ করা এবং রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্যের প্রস্তাব করা হয়েছে প্রস্তাবনায়।
বুধবার রাজধানীর একটি হোটেলে সংবাদ সম্মেলনে এসব প্রস্তাব তুলে ধরেন জামায়াতের নায়েব আমীর ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মো তাহের। এর আগে জামায়াত আমীর ডা. শফিকুর রহমান বলেন, ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর তৎকালীন সেনা সমর্থিত সরকারের সঙ্গে সমঝোতা করে অবৈধভাবে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা দখল করে। তারা দেশকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার জন্য সংবিধানসহ সিভিল প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বিচার বিভাগকে কুক্ষিগত করে একনায়কতন্ত্র কায়েম করে। কেয়ারটেকার সরকারপদ্ধতি বাতিলসহ নিজেদের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার জন্য নির্বাহী বিভাগ, বিচার বিভাগ, নির্বাচন ব্যবস্থা, সাংবিধানিক এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহ, শিক্ষা, সংস্কৃতি, দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং ধর্মীয় মূল্যবোধকে ধ্বংস করে দেয়। রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বিরোধীমত দমনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
তিনি আরও বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার দুর্নীতি, ব্যাংক লুটপাট, শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি ও বিদেশে অর্থ পাচারের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করে দেয়। হত্যা, গুম এবং মিথ্যা, সাজানো ও ষড়যন্ত্রমূলক মামলার মাধ্যমে বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে হাজার হাজার মামলা দায়ের করে জেল-জুলুম ও নির্যাতন চালায়।
ডা. শফিক বলেছেন, ৮ আগস্ট গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান দায়িত্ব স্বল্পতম সময়ের মধ্যে মৌলিক সংস্কার সম্পন্ন করে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা। নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু ও অর্থবহ করার জন্য নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠানের ব্যাপক সংস্কার প্রয়োজন। সংস্কার ব্যতীত নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হতে পারে না।
জামায়াত ধর্মভিত্তিক হলেও দলটির প্রস্তাবে ইসলামী শাসন ব্যবস্থা বা শরিয়া শাসনের কথা নেই। রয়েছে ইসলামী শিক্ষায় জোরের প্রস্তাব। ধর্মীয় অবমাননা বন্ধ করা, ব্যক্তি বা প্রাণীর পরিবর্তে দেশীয় ঐতিহ্যের ভাস্কর্য নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়েছে।
প্রথম দফায় আইন ও বিচার বিভাগের সংস্কারের প্রস্তাবে বলা হয়েছে, উচ্চ আদালতে বিচারপতি নিয়োগের জন্য সুষ্ঠু ও সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। বিচার বিভাগ থেকে দ্বৈত শাসন দূর করতে হবে। আইন মন্ত্রণালয় থেকে আলাদা করে সুপ্রিম কোর্টের অধীনে পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিল করতে হবে। বিচারের দীর্ঘসূত্রিতা কমাতে বিভাগীয় পর্যায়ে হাইকোর্ট বেঞ্চ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। দেওয়ানী মামলার জন্য সর্বোচ্চ ৫ বছর এবং ফৌজদারি মামলাসমূহ সর্বোচ্চ ৩ বছরের মধ্যে নিষ্পত্তি করার বিধান করতে হবে।
সংসদবিষয়ক সংস্কার প্রস্তাবে বলা হয়েছে, প্রধান বিরোধীদল থেকে একজন ডেপুটি স্পিকার মনোনীত করতে হবে। বিরোধী দলীয় নেতার নেতৃত্বে ছায়া মন্ত্রিসভা গঠনের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার প্রস্তাবে বলা হয়েছে, সংসদ নির্বাচনে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক ব্যবস্থা চালু করতে হবে। কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে স্থায়ীভাবে সন্নিবেশিত করতে হবে। ইভিএম ভোটিং ব্যবস্থা বাতিল করতে হবে। স্থানীয় সরকার নির্বাচন নির্দলীয়ভাবে করতে হবে। সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন প্রথা বাতিল করতে হবে। প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ অন্যান্য কমিশনার নিয়োগের জন্য প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা ও প্রধান বিচারপতির সমন্বয়ে সার্চ কমিটি গঠিত হবে। সংসদ নির্বাচন একাধিক দিনে করতে হবে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংস্কার প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ১৮৬১ সালে ব্রিটিশ সরকার প্রণীত পুলিশ আইন পরিবর্তন এবং পুলিশের জন্য নীতিমালা তৈরি করতে হবে। পুলিশ সদস্যদের নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি এবং চাকরিচ্যুতির জন্য স্বাধীন কমিশন গঠন করতে হবে। পুলিশ ট্রেনিং ম্যানুয়ালের মধ্যে ধর্মীয় শিক্ষা ও নৈতিক অনুশাসন অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
পুলিশের মারণাস্ত্রের ব্যবহার বাতিল করতে হবে। রিমান্ডে আসামিপক্ষের আইনজীবীর এবং মহিলা আসামির ক্ষেত্রে অভিভাবকের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে। বিচার বিভাগীয় সদস্যদের নিয়ে পুলিশ ট্রাইব্যুনাল গঠনের বিধান থাকতে হবে। পুলিশের দায়িত্ব ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা উন্নত করতে হবে। র্যাব ও অন্যান্য বিশেষায়িত বাহিনীর প্রতি জনসাধারণের আস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার সম্পন্ন করতে হবে। বিচারবহির্ভূতসহ সব হত্যাকাণ্ড বন্ধ করতে হবে।
জনপ্রশাসন সংস্কার প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি থেকে শুরু করে নিয়োগ পর্যন্ত সময়ক্ষেপণ না করে যৌক্তিক সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করতে হবে। সরকারি চাকরিতে আবেদন বিনামূল্যে করতে হবে। আবেদনের বয়সসীমা আগামী ২ বছরের জন্য ৩৫ বছর ও পরবর্তী বয়সসীমা স্থায়ীভাবে ৩৩ বছর এবং অবসরের বয়সসীমা ৬২ বছর নির্ধারণ করতে হবে। বিরাজমান আন্তঃক্যাডার বৈষম্য দূর করতে হবে। আওয়ামী সরকারের আমলে যারা প্রশ্নপত্র ফাঁস, দুর্নীতি, জালিয়াতি ও দলীয় বিবেচনায় চাকরি পেয়েছেন, তাদের নিয়োগ বাতিল করতে হবে।
শিক্ষা ও সংস্কৃতি সংস্কার প্রস্তাবে জেএসসি পরীক্ষা ফেরানো, পাঠ্যপুস্তকে ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের ইতিহাস তুলে ধরা, ধর্মীয় মূল্যবোধবিরোধী উপাদান বাদ দেওয়া, নবী (সা.)-এর জীবনীসহ মহামানবদের জীবনী সংযোজন, কারিগরি শিক্ষাকে মূলধারায় যুক্ত করা, শিক্ষা সংস্কারের কমিশনে আলিয়া, কওমীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিতের প্রস্তাব করা হয়েছে।
পররাষ্ট্রবিষয়ক সংস্কারে বহুপাক্ষিক পানি চুক্তি এবং আওয়ামী লীগ আমলে সই হওয়া আন্তর্জাতিক চুক্তি চুক্তি রিভিউয়ে কমিশন গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে।