চৌধুরী জুয়েল রানা স্টাফ রিপোর্টার
ভোর থেকে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। বেলা বাড়তেই শুরু হয় ঝুম বৃষ্টি। ভরদুপুরেও বৃষ্টি না থামায় অনেকটা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতা। কিন্তু ততক্ষণে দূরদূরান্ত থেকে ছাতা মাথায় দিয়ে দর্শনার্থীরা এসে ভিড় করেছেন নদীর পাড়ে। প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে ঘাটে চলে এসেছেন নৌকাসহ মাঝিমাল্লারা। সবার আগমন দেখে বৃষ্টির মধ্যেই প্রতিযোগিতা আয়োজনের সিদ্ধান্ত নিলেন আয়োজকেরা। বেলা তিনটার পরপরই থেমে যায় বৃষ্টি, শুরু হয় প্রতিযোগিতা। আনন্দ-উল্লাসে মেতে ওঠে মানুষ।
বৃহস্পতিবার সকাল থেকে এসব দৃশ্যের দেখা মেলে নড়াইলের কালিয়া উপজেলার নড়াগাতী থানার খাশিয়াল ইউনিয়নের বড়দিয়া বাজার এলাকায়। সেখানে হিন্দু সম্প্রদায়ের লক্ষ্মীপূজা উপলক্ষে সাত দিনব্যাপী মেলার আয়োজন করা হয়েছিল। বৃহস্পতিবার মেলার শেষ দিনে বিশেষ আকর্ষণ হিসেবে নবগঙ্গা-মধুমতী নদীর মিলনস্থলে আয়োজন করা হয় আবহমান গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতা।
প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিল আশপাশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা ভাই–বোন স্বপ্ন তরী, মা-শীতলক্ষ্যা, জয় মা কালী, মোবাইল বাচাড়ি ও তুফান নামের পাঁচটি নৌকা। নৌকাগুলোর যেমন বাহারি নাম, দেখতেও দৃষ্টিনন্দন। দারুণ প্রাণোচ্ছল তার মাঝি-মাল্লার দল। নদীর বুকে তাঁদের ছুটে চলা ও বইঠার ছলাৎ ছলাৎ শব্দে মাতোয়ারা হয়ে ওঠে নদীর দুই পাড়ে থাকা হাজারো দর্শনার্থী। নদীমাতৃক বাংলাদেশে নৌকাবাইচ লোকায়ত বাংলার লোকসংস্কৃতির যে অংশ, তা ভুলে যায়নি বাঙালি। তাই তো হেমন্তের বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে নদীপাড়ে মানুষের ঢল নামে।
বৃষ্টি উপেক্ষা করে পরিবার নিয়ে নৌকাবাইচ দেখতে আসা চৌধুরী জুয়েল রানা বলেন, ‘ছোটবেলা থেকে নৌকাবাইচ দেখার অভ্যাস। এটি আমার খুবই প্রিয়। তাই বন্ধু বান্ধবী নিয়ে নৌকাবাইচ দেখে আনন্দ করার জন্য এখানে এসেছি।
দর্শনার্থীরা বলেন, আবহমান গ্রামবাংলার এই ঐতিহ্য দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে। মানুষ এটাকে পছন্দ করে। এই ঐতিহ্য ধরে রাখতে সবাইকে উদ্যোগী হতে হবে। নদীমাতৃক বাংলাদেশে যেখানেই নদী আছে, সেখানে স্থানীয় মানুষ, প্রশাসন ও সরকারকে বলতে চাই, প্রতিবছর নদীতে এমন প্রতিযোগিতামূলক নৌকাবাইচের আয়োজন করুন।
আয়োজকেরা জানান, নবগঙ্গা নদীর বুক থেকে শুরু হয়ে দুই কিলোমিটার দূরে মধুমতীতে গিয়ে শেষ হয় নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতা। চারটি ধাপে সম্পন্ন হওয়া এই প্রতিযোগিতা চলে বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত। চূড়ান্ত পর্বে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে গোপালগঞ্জের মোবাইল বাচাড়ি, রানার্সআপ হয়েছে বাশুড়িয়ার তুফান, তৃতীয় হয়েছে জয় মা কালী। পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন জেলা বিএনপির সভাপতি বিশ্বাস জাহাঙ্গীর আলম। প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন লোহাগড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফাতেমা আজরিন তন্বী।
মেলা উদযাপন কার্যনির্বাহী পরিষদের আহ্বায়ক ও খাশিয়াল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বি এম বরকত উল্লাহ বলেন, বড়দিয়ায় লক্ষ্মীপূজার মেলা দেড় শ বছর আগে থেকে হয়ে আসছে। মেলা উপলক্ষে যাত্রাগান, পালাগান, নৌকাবাইচসহ বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। তবে মাঝে দীর্ঘ ১৮ বছর শুধু মেলা হতো। নৌকাবাইচ বন্ধ ছিল, এ বছর আয়োজন করেছেন। হাজার হাজার মানুষ এটা উপভোগ করেছে। ভবিষ্যতে এ আয়োজন অব্যাহত থাকবে এবং আরও অনেক ধরনের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে। তিনি আরও বলেন, ‘এলাকার মানুষ যাতে সুস্থ ধারার সংস্কৃতিচর্চা করতে পারে এবং বাঙালি সংস্কৃতির ঐতিহ্য যাতে আমরা ধরে রাখতে পারি এবং নবায়িত করতে পারি, সেটাই আমাদের উদ্দেশ্য।’