মোহাম্মদ ইয়াছিন তোহা
বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণ টার্মটি আইনী অপব্যাখ্যার শামিল।
ভালোবাসা বলতে একটি তীব্র আকর্ষণ এবং মানসিক সংযুক্তির অনুভূতিকে বোঝায়। ভালোবাসাকে ইতিবাচক এবং নেতিবাচক উভয়ই মনে করা হয়। এর গুণগুলো মানুষের উদারতা, সহানুভূতি এবং স্নেহের প্রতিনিধিত্ব করে যেমন অন্যের ভালোর জন্য নিঃস্বার্থ থাকা এবং উদ্বেগ প্রকাশ করা। আর প্রেম বা কল্পনাপ্রবণ ভালোবাসা হলো ভালবাসার অনুভূতি বা অন্য ব্যক্তির প্রতি তীব্র আকর্ষণ আর সেই সামগ্রিক অনুভূতি এবং আবেগ প্রকাশ করার জন্য ফলস্বরূপ একজন ব্যক্তির দ্বারা গৃহীত প্রণয় আচরণ।
নারী-পুরুষের প্রেম থেকে ভালোবাসা এবং ভালোবাসা থেকে প্রণয়ের সৃষ্টি হয়। প্রণয় সৃষ্টি হওয়ার আগে নারী-পুরুষের মধ্যকার যে সম্পর্কটা বিদ্যমাণ থাকে সেটাকে প্রেম হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। মানব সৃষ্টির ইতিহাসের সাথে জড়িয়ে আছে প্রেম ভালোবাসার গল্প। মানুষের মানবিক বৈশিষ্ট্যের অন্যতম হলো ভালোবাসা। আগেকার সময়ে প্রেম-ভালোবাসার এক নিগূঢ় মর্মার্থ থাকলেও ইদানীংকালে ইহা খুবই নিম্নতরে পৌঁছেছে। মূলত ডিজিটালাইজেশনের কারণে সোশ্যাল মিডিয়ার কুপ্রভাবে হরহামেশাই প্রেম-ভালোবাসার গল্প বুনা হচ্ছে, আবার মুহূর্তেই ঘটছে বিচ্ছেদ।
পশ্চিমা সংস্কৃতির বলয়ে প্রাচ্য দেশ গুলোতেও ভালোবাসার সম্পর্কটা এখন আর ইতিবাচক নেই। আমাদের দেশেও প্রেম-ভালোবাসা মানেই হলো লিভ-টুগেদার। লিভ-টুগেদার আইনত দন্ডনীয় হলেও ইহা যেন ব্যবহারিক প্রথায় পরিণত হয়েছে। নারী-পুরুষ যথেচ্ছা প্রেম-ভালোবাসার নামে লিভ-টুগেদার করছে কিন্তু যখনই পুরুষের সাথে নারীর মনের অমিল দেখা দেয় তখনই শুনতে পাওয়া যায় ‘বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণ’ নামক টার্মটি।
বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণ কথাটি আইনের অপব্যাখ্যার শামিল। ধর্ষণ সংক্রান্ত আইন তথা বাংলাদেশ দন্ডবিধি এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে নজর বুলালে এবং ধর্ষণ শব্দটিকে আইন ব্যাখ্যার মূলনীতি ও বিজ্ঞ আদালেতের নজীর দিয়ে বিশ্লেষণ করলে বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণ কথাটির কোন অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন প্রণয়ণের পূর্ব পর্যন্ত বাংলাদেশ দন্ডবিধি দ্বারা ধর্ষণের বিচার হলেও নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন প্রণয়ণের পর দন্ডবিধিতে বিচার বন্ধ হয়ে যায়। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ধর্ষণের বিচার হলেও ধর্ষণের সংজ্ঞা নেয়া হচ্ছে দন্ডবিধি থেকে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) আইন, ২০২০ এর ২ (ঙ) ধারায় বলা হয়েছে, ‘ধর্ষণ’ অর্থ ধারা ৯ এর বিধান সাপেক্ষে, দন্ডবিধি,১৮৬০ এর ধারা ৩৭৫ এ বর্ণিত সংজ্ঞা ‘ধর্ষণ’। দন্ডবিধি, ১৮৬০ এর ৩৭৫ ধারায় ৫ টি অবস্থায় শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করলে তাকে ধর্ষণ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। এক. নারীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে; দুই. নারীর সম্মতি ছাড়া; তিন. নারীর সম্মতি আদায়, তবে তা মৃত্যু কিংবা জখমের ভয় দেখিয়ে; চার. নারীর সম্মতি নিয়েই, কিন্তু পুরুষটি জানেন যে, তিনি ওই নারীর স্বামী নন এবং ওই নারী তাঁকে এমন একজন পুরুষ বলে ভুল করছেন যে পুরুষটির সঙ্গে তাঁর আইনসংগতভাবে বিয়ে হয়েছে বা বিবাহিত বলে তিনি বিশ্বাস করেন। পাঁচ. নারীর সম্মতিসহ বা সম্মতি ছাড়া তবে সেই নারীর বয়স যদি হয় ১৪ বছরের কম। বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণের বিষয়টি বিশ্লেষণে দেখা যায়, সেখানে অভিযুক্ত ব্যক্তি বিয়ের প্রলোভনে নারীর সম্মতি আদায় করেন, যা ৩৭৫ ধারায় ধর্ষণের সংজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত নয়।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০২০ এর ধারা ৯(১) এর ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, যদি কোনো পুরুষ বিবাহবন্ধন ছাড়া ১৬ বছরের অধিক বয়সের কোনো নারীর সঙ্গে তাঁর সম্মতি ছাড়া বা ভীতি প্রদর্শন বা প্রতারণামূলকভাবে তাঁর সম্মতি আদায় করে, অথবা ১৬ বছরের কম বয়সের কোনো নারীর সঙ্গে তার সম্মতিসহ বা সম্মতি ছাড়া শারীরিক সম্পর্ক করেন, তা হলে তিনি ওই নারীকে ধর্ষণ করেছেন বলে গণ্য হবে। এই ধারায়ও এটা স্পষ্ট যে, নারীর সম্মতিসহ শারীরিক সম্পর্ক করলে ইহা ধর্ষণ হবেন না; যদি না নারীর বয়স ১৬ বছরের কম হয়। জেনারেল ক্লজের অ্যাক্টে বলা হয়েছে, আইনের শব্দ গুলোকে সংশ্লিষ্ট আইনের ভাষায় ব্যাখ্যা করতে হবে। অর্থ্যাৎ, আইনে যে দৃষ্টিতে শব্দটি ব্যহার করা হয়েছে সেটিকে সামনে রেখেই শব্দটির ব্যাখ্যা করতেম হবে। সুতরাং, আইন ব্যাখ্যার মূলনীতি আলোকে কোনভাবেই বিয়ের প্রলোভনে শারীরিক সম্পর্ককে ধর্ষণের আওতায় বিবেচনা করা যায় না।
‘বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণ’ এ প্রকারের মামলা কখনোই ধর্ষণের অপরাধ হিসেবে দাবি করা যায় না। কারণ মুসলিম ম্যারেজ হলো সিভিল ম্যাটার। ১৮ বছরের বেশি বয়সের যে কোনো নারী নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নিতে পারে, বিয়ের প্রস্তাব দিতে পারে বা গ্রহণ করতে পারে; কাজেই প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ হবে সিভিল ম্যাটার। কোনো পুরুষ কোনো নারীর সঙ্গে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে সেটি লঙ্ঘন করলে তা হবে বিবাহ চুক্তির লঙ্ঘন। তবে এটি হলো সিভিল সংক্রান্ত ব্যাপার, মোটেই ধর্ষণের অপরাধ নয়।
ভারতের উচ্চ আদালত বলেছেন, কোনো নারী স্বেচ্ছায় দীর্ঘদিন ধরে কারও সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক বজায় রাখার পর ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণের অভিযোগ দায়ের করতে পারবেন না। ২০১৭ সালে বোম্বে হাইকোর্ট একটি মামলায় পর্যবেক্ষণ দেন, প্রাপ্তবয়স্ক নারীদের ক্ষেত্রে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে শারীরিক সম্পর্ককে ধর্ষণ হিসেবে গণ্য করা যাবে না। মামলার রায়ে বোম্বে হাইকোর্টের বিচারপতি মৃদুলা ভাটকার বলেন, ‘দুজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির মধ্যে শারীরিক সম্পর্ক যদি সেই মুহূর্তে উভয়ের সম্মতিতেই হয়ে থাকে, তা হলে তা কীভাবে ধর্ষণ হবে?’ তিনি বলেন, ‘নিজেদের ইচ্ছাতেই প্রেমিক–প্রেমিকা অনেক বেশি ঘনিষ্ঠ হয়ে থাকেন। পরে আবার অনেকেই এটাকে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ধর্ষণের অভিযোগ তোলেন। এটা হওয়া উচিত নয়।’
৫৭ ডিএলআর ৫৯১ পৃষ্ঠায় দেখা যায়, উচ্চ আদালত মন্তব্য করেন যে, যেহেতু অভিযুক্ত ব্যক্তির সঙ্গে অভিযোগকারীনীর যৌন সঙ্গমে অভ্যস্ত প্রমাণিত হয় এবং উক্ত নারী কখনো সঙ্গমে বাঁধা প্রদান করেনি বা চিৎকার করেনি সেহেতু তা ধর্ষণের অপরাধ বলে গণ্য হবে না।
৫১ ডিএলআরের ১২৯ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে, হানিফ সেখ বনাম আছিয়া বেগম মামলা মহামানস্য সুপ্রীম কোর্ট মন্তব্য করেন যে, ১৬ বছরের অধিক বয়সের কোনো নারীকে যদি কোনো পুরুষ বিয়ের প্রলোভন দিয়ে সঙ্গম করে তা হলে তা ধর্ষষ বলে গণ্য হবে না। তবে ভিকটিম যদি ১৪ বছরের কম বয়সি হয়, তাহলে সেটিকে ‘ধর্ষণ’ বলা হবে।
২০০৭ সালে মনোয়ার মল্লিক বনাম রাষ্ট্র মামলায় বিচারপতি ছিদ্দিকুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি রেজাউল হকের হাইকোর্ট বেঞ্চ একটি রায় দিয়েছিল। এতে বলা হয়, ‘অভিযোগকারী নারী বিয়ের প্রতিশ্রুতিতে স্বেচ্ছায় যৌন মিলন করেছেন। তবে এ কারণে আসামিকে ধর্ষণের অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করা যাবে না।’২০১৬ সালে নাজিম উদ্দিন বনাম রাষ্ট্র মামলায় বিচারপতি এমদাদুল হক ও বিচারপতি আশীষ রঞ্জন দাসের হাইকোর্ট বেঞ্চ রায় দেয় যে, ‘সার্বিক পরিস্থিতি এবং সাক্ষ্য প্রমাণে এটা প্রমাণিত হয় না যে, এখানে এক পক্ষ দোষী। বরং এ কাজে দুই জনের সমান অংশগ্রহণ রয়েছে। তাই ধর্ষণের জন্য শুধু পুরুষ সঙ্গীকে দায়ী করা যায় না।’
১৯৯১ সালে হাইকোর্ট বিভাগ লুকুছ মিয়া বনাম রাষ্ট্র মামলায় একটি পর্যবেক্ষণ দেয়। ‘বিয়ের প্রলোভনে’ যৌন সম্পর্ক কি ধর্ষণ? বিচারপতি আব্দুল বারী সরকার ও বিচারপতি হাবিবুর রহমান খানের হাইকোর্ট বেঞ্চ লুকুছ মিয়ার বিরুদ্ধে বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণের অভিযোগ খারিজ করে বলে, ‘এটি অপরাধের মধ্যে পড়ে না। তার কারণ অভিযোগকারী নারী স্বেচ্ছায় যৌন সম্পর্কে অংশ নিয়েছেন।
উপরিউক্ত আইন ও নজীর বিবেচনায় বিয়ের প্রলোভনে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করাকে ধর্ষণ বলে অভিহিত করা যায় না। বড় জোর এটিকে প্রতারণার অন্তর্ভুক্ত করা যায়।
লেখক, মুহাম্মদ ইয়াছিন তোহা
কলামিস্ট ও মানবাধিকার এক্টিভিস্ট
আইনজীবী, জেলা ও দায়রা জজ আদালত, ঢাকা। মোবাইল- ০১৭৮১ ৭০৪৩৬৮