চৌধুরী জুয়েল রানা স্টাফ রিপোর্টার
কারো পুড়েছে বাড়ি, কারো ভেঙ্গেছে ফ্রিজসহ আসবাবপত্র এভাবে কমপক্ষে ৫০টি বাড়িঘর ভাংচুর করে আগুন জ্বালিয়ে ভস্বিভুত করা হয়েছে। এদের বেশিরভাগই ৩ বেলা খাওয়া হয়নি গত শনিবার থেকে। নিজের বাড়ি হারিয়ে অন্যের বাড়ি থাকছেন। সাংবাদিক এসেছে শুনে কাঁদতে কাঁদতে পোড়া বাড়ির উঠানে দাড়িয়ে অভিযোগ করছেন।
রোববার (২৯ সেপ্টেম্বর) সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেল নড়াইল জেলার নড়াগাতী থানার খাশিয়াল বাজারের পাশেই জাফর বিশ্বাসের বাড়ির কয়েকটি ঘর পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। আগুনে গাছের পাতা পর্যন্ত পুড়ে যাবার চিহ্ন পাওয়া গেলো। ভিতরে প্রবেশ করে দেখা গেলো বই-খাতা সহ সবকিছু পুড়ে ভস্বিভুত হয়েছে। একটু পরেই জাফর বিশ্বসের দুই মেয়ে কাঁদতে কাঁদতে বাড়িতে প্রবেশ করলেন।
ছোটমেয়ে সুমাইয়া গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু বিশ্ববিদ্যালয়ের আনার্স ২য় বর্ষের ছাত্রী। অভিযোগের সুরে বললো, পুলিশের সামনেই আমাদের ঘর পুড়িয়ে দিলো, আমার সমস্ত বই খাতা, সনদ পুড়ে ছাই হয়ে গেলো। আমাদের বাড়িতে কোন পুরুষ মানুষ নাই আমরা ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছি।
খাশিয়াল গ্রামের জাফর বিশ্বাস ছাড়াও আগুনে পুড়েছে দলীয় প্রধান সাবেক ইউপি সদস্য জাফর মোল্যা, চঞ্চল শেখ, আইয়ুব মোল্যা, শওকত শেখ, মুকুল শেখ, আতাউর শেখ, আশরাফ শেখ,মুন্না শেখ সহ অন্ততঃ ৫০টি বাড়ি। এসব বাড়ির পুরুষেরা ঘরছেড়ে পালিয়ে আছেন।
নিজের একমাত্র বসত ঘরটি পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়েছে প্রতিপক্ষ। ঘরের টিনগুলো দুমড়ে মুচড়ে গেছে কোথাও কোন ভালো চিহ্ন নেই। ঘর হারিয়ে উদভ্রান্ত উত্তর পাড়ার আমেনা বেগম গর্জে উঠলেন। বললেন, আমি আমার ছোট বাচ্চা নিয়ে কোনরকমে ঘর থেকে বের হইছি। আমার কোন থাকার জায়গা নাই-আল্লাহ আমার ঘর যারা পুড়াইছে তাদেরও যেন সবকিছু পুড়ে ছাই হয়ে যায়।
এলাকাবাসীর সাথে কথা বলে জানা গেছে, খাশিয়াল গ্রামে ওহাব শেখ ও জাফর মোল্যা এই দুই গ্রুপে আধিপত্য বিস্তারের কোন্দল বিরাজমান। চলতি ঘটনার শুরু বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে যাওয়া নিয়ে। ৪ আগষ্ট বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মিছিলে নড়াইলে আসে খাসিয়াল গ্রামের ওসিকুল নামের একজন জামাত কর্মী। এই মিছিলে আসাকে কেন্দ্র করে বাকবিতন্ডায় ৯ আগষ্ট তাকে মারধর করে জাফর মোল্যা গ্রুপের লোকজন। এর জের ধরে গত ২৪ সেপ্টেম্বর ওহাব শেখের লোকজন জাফর মোল্যাকে কুপিয়ে জখম করে।
এই ঘটনার প্রতিশোধ নিতে মরিয়া হয়ে ওঠে জাফর মোল্যার লোকেরা। শুক্রবার (২৭ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যায় জাফর মোল্যার লোকজন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে মাষ্টার্স পড়ুয়া ছাত্র মিলন শেখকে কুপিয়ে হাত ও পায়ের আঙ্গুল কেটে ফেলে।
শুক্রবার রাতেই দুইপক্ষ ঘোষনা দিয়ে শনিবার (২৮ সেপ্টেম্বর) হামলায় লিপ্ত হতে চাইলে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপে তা থেমে যায়। ওইদিন সকালে সেনাবাহিনীর অভিযানে দেশীয় অস্ত্র ও একটি আগ্নেয়াস্ত্র সহ চারজনকে গ্রেপ্তার করে। ওইদিন বিকালে নড়াগাতি থানা পুলিশ ও ২ জনকে আটক করে।
সেনাবাহিনী এলাকা থেকে চলে যাবার পরপরই সকাল ১১ টা থেকে ওহাব শেখের লোকেরা জাফর মোল্যা গ্রুপের খাশিয়াল উত্তর পাড়ার বিভিন্ন বাড়িতে ভাংচুর ও লুটপাট চালায়। ভাংচুর চলে রাত অবধি। এলাকার লোকেরা ভয়ে এ ঘটনায় কোন মামলা করেনি।
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশগ্রহনকারী জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মাষ্টার্স শেষ বর্ষের ছাত্র ছাত্রদল নেতা মিলন শেখের পরিবারে চলছে হতাশা। বৃদ্ধবাবা আবু হানিফ শেখ ছেলের পঙ্গুত্বের জন্য কাঁদছেন। সাত ভাইবোনের মধ্যে সবার ছোট মিলনের হাত ও পায়ের সবগুলো আঙ্গুলই কেটে ফেলেছে প্রতিপক্ষের লোকেরা। বর্তমানে সে ঢাকা পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
মিলনের মেজভাই চুন্নু শেখ সাংবাদিকদের বলেন, ঢাকায় আন্দোলন করেছে আমার ভাই। সে সেখানে সহ সমন্বয়ক ছিলো। সে কোন গ্রাম্য কোন্দলে জড়িত নয়। আমাদের পরিবারের প্রায় সবাই প্রায় বিদেশ থাকি। তাকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কমপক্ষে ২৯টি কোপ দিয়েছে প্রতিপক্ষের লোকজন। আমরা এর সুষ্টু বিচার চাই। পরবর্তী বাড়িঘর ভাংচুর আগুনে আপনারা জড়িত কি না-এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আমরা আমাদের ভাইকে চিকিৎসা দিতেই ব্যস্ত রয়েছি। তবে শুনেছি মিলনের এমন অবস্থা দেখে ছাত্র সংগঠনের ছাত্ররা ক্ষুব্ধ হয়ে প্রতিশোধ নিতে পারে।
নড়াগাতী থানার ওসি মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, পুলিশের সামনে ঘটেছে এটা ঠিক নয়, সেনাবাহিনী চলে যাবার পরে আগুন আর ভাংচুরের ঘটনা ঘটেছে। খবর পেয়ে আমরা ত্ৎাক্ষনিকভাবে আগুন নেভানোর চেষ্টা করেছি। তারা কোন অভিযোগ করলে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।