আখলাকঃ ----
আখলাক আরবি শব্দ । এটি বহুবচন । এক বচন খুলুকুন । এর আভিধানিক অর্থ- স্বভাব, চরিত্র, ইত্যাদি । শব্দগত বিবেচনায় আখলাক বলতে সচ্চরিত্র ও দুশ্চরিত্র উভয়কেই বোঝায় । তবে প্রচলিত অর্থে আখলাক শুধু সচ্চরিত্রকেই বুঝায়। যেমন ভালো চরিত্রের মানুষকে আমরা চরিত্রবান বলি । আর মন্দ চরিত্রের মানুষকে বলি চরিত্রহীন । ব্যবহারিক বিবেচনায় আখলাক দ্বারা ভালো ও উত্তম চরিত্রকে বোঝানো হয় ।
মূলত আখলাক হলো মানুষের স্বভাবসমূহের সমন্বিত রূপ । মানুষের আচার-আচরণ, চিন্তা-ভাবনা, মানসিকতা, কর্মপন্থা সবকিছুকে একত্রে চরিত্র বা আখলাক বলা হয় । তা ভালো কিংবা মন্দ হতে পারে । এককথায়, মানুষের সকল কাজ ও নীতির সমষ্টিকেই আখলাক বলা হয় ।
আখলাক দু'প্রকারঃ (ক.) আখলাকে হামিদাহ (খ.) আখলাকে যামিমাহ।
আখলাকে হামিদাহ হলো মানুষের প্রশংসনীয় গুণাবলি আর আখলাকে যামিমাহ মানব স্বভাবের মন্দ অভ্যাসগুলোর সামষ্টিক নাম । আমরা আলোচ্য অধ্যায়ে এ দু'প্রকার আখলাকের পরিচয়, গুরুত্ব, কুফল এবং কতিপয় ভালো ও মন্দ চরিত্র সম্পর্কে জানব।
আখলাকে হামিদাহঃ
আখলাক অর্থ চরিত্র, স্বভাব। আর হামিদাহ অর্থ প্রশংসনীয় । সুতরাং আখলাকে হামিদাহ অর্থ প্রশংসনীয় চরিত্র, সচ্চরিত্র । ইসলামি পরিভাষায়, যেসব স্বভাব বা চরিত্র সমাজে প্রশংসনীয় ও সমাদৃত, আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রাসুল (স.)-এর নিকট প্রিয় সেসব স্বভাব বা চরিত্রকে আখলাকে হামিদাহ বলা হয় ।
এককথায়, মানব চরিত্রের সুন্দর, নির্মল ও মার্জিত গুণাবলিকে আখলাকে হামিদাহ বলা হয় । মানুষের সার্বিক আচার-আচরণ যখন শরিয়ত অনুসারে সুন্দর, সুষ্ঠু ও কল্যাণকর হয় তখন সে স্বভাব-চরিত্রকে বলা হয় আখলাকে হামিদাহ ।
আখলাকে হামিদাহকে আখলাকে হাসানাহ বা হুসনুল খুল্কও বলা হয় । আখলাকে হাসানাহ অর্থ সুন্দর চরিত্র । মানব চরিত্রের উত্তম ও নৈতিক গুণাবলি আখলাকে হামিদাহ এর অন্তর্ভুক্ত । যেমন- সততা, সত্যবাদিতা, ওয়াদা পালন, মানব সেবা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, দয়া, ক্ষমা ইত্যাদি।
আখলাকে হামিদাহ মানবীয় মৌলিক গুণ ও জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ । এর দ্বারাই মানুষ পূর্ণমাত্রায় মনুষ্যত্বের স্তরে উপনীত হয় । মানবিকতা ও নৈতিকতার আদর্শ আখলাকে হামিদাহর মাধ্যমেই পরিপূর্ণতা লাভ করে । মানুষের ইহ ও পরকালীন সুখ, শান্তি উত্তম আখলাকের উপরই নির্ভরশীল । সৎচরিত্রবান ব্যক্তি যেমন সমাজের চোখে ভালো তেমনি মহান আল্লাহর নিকটও প্রিয় । মহানবি (স.)-এর হাদিসে বলা হয়েছে-
أحَبُّ النَّاسِ إِلَى اللهِ أَحْسَنُهُمْ خُلُقًا
অর্থ : “আল্লাহ তায়ালার নিকট সেই লোকই অধিক প্রিয়, চরিত্রের বিচারে যে উত্তম ।” (ইবনে হিব্বান) এ জন্য মানুষকে আখলাক শিক্ষা দেওয়াও নবি-রাসুলগণের অন্যতম দায়িত্ব ছিল । আমাদের প্রিয়নবি হযরত মুহাম্মদ (স.) ছিলেন সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী । সব ধরনের সৎগুণ তাঁর চরিত্রে পাওয়া যায় । স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা তাঁর প্রসঙ্গে বলেছেন-
وَإِنَّكَ لَعَلَى خُلُقٍ عَظِيمٍ 0
অর্থ : “নিশ্চয়ই আপনি মহান চরিত্রের ধারক ।” (সূরা আল কালাম, আয়াত ৪) রাসুলুল্লাহ (স.) ঘোষণা করেছেন,
اتما بُعِثْتُ لِأُتَيْمَ مَكَارِمَ الْأَخْلَاقِ -
অর্থ : “উত্তম চারিত্রিক গুণাবলিকে পূর্ণতা দানের জন্যই আমি প্রেরিত হয়েছি ।” (বায়হাকি)
রাসুলুল্লাহ (স.) নিজে যেমন উত্তম চরিত্রের অধিকারী ছিলেন তেমনি মানবজাতিকে সচ্চরিত্র গঠনের শিক্ষা দিয়েছেন । পূর্ণাঙ্গ মুমিন হওয়ার জন্য তিনি সৎ ও নৈতিক স্বভাব অনুশীলনের নির্দেশ দিয়েছেন । তিনি বলেছেন, “মুমিনগণের মধ্যে সেই পূর্ণ ইমানের অধিকারী, যে তাদের মধ্যে চরিত্রের বিচারে সবচেয়ে উত্তম ।” (তিরমিযি)
প্রকৃতপক্ষে সৎচরিত্র পরকালীন জীবনেও মানুষের কল্যাণের হাতিয়ার, মুক্তির উপায় হবে।
উত্তম আচার-আচরণ মানুষকে পুণ্য বা সাওয়াব দান করে । মহানবি (স.) বলেছেন, : “সুন্দর চরিত্রই পুণ্য ।” (মুসলিম)
প্রশংসনীয় আচরণ ও স্বভাব কিয়ামতের দিন মুমিনের পাল্লা ভারী করবে। একটি হাদিসে রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, “নিশ্চয়ই (কিয়ামতের দিন) মিযানে সুন্দর চরিত্র অপেক্ষা ভারী বস্তু আর কিছুই থাকবে না ।” (তিরমিযি)
দুনিয়ার জীবনেও আখলাকে হামিদাহ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সচ্চরিত্র ব্যক্তিকে সমাজের সবাই ভালোবাসে, বিশ্বাস করে । সবাই তাকে শ্রদ্ধা করে, সম্মান দেখায় । তাঁর বিপদে-আপদে এগিয়ে আসে।
চরিত্রের কারণে তিনি সমাজে মর্যাদার উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত হন। মহানবি (স.) এ সম্পর্কে বলেছেন,
خيَارُكُمْ أَحْسَنُكُمْ اَخْلَاقًا -
অর্থ : “তোমাদের মধ্যে উত্তম ঐ সকল ব্যক্তি, যারা তোমাদের মধ্যে চরিত্র বিচারে সুন্দরতম।” (বুখারি)
সমাজের সকলে চরিত্রবান হলে সেখানে কোনোরূপ হিংসা-বিদ্বেষ, মারামারি, হানাহানি থাকে না । সমাজ সুখে-শান্তিতে ভরে ওঠে ।
সৎচরিত্র আল্লাহ তায়ালার এক বিশেষ নিয়ামত । দুনিয়ায় আগত সকল নবি-রাসুলই উত্তম চরিত্রের অধিকারী ছিলেন। এ ছাড়াও পৃথিবীর স্মরণীয় ও বরণীয় মনীষীগণও উত্তম নৈতিক আদর্শ অনুশীলন করতেন। সৎচরিত্রের মাধ্যমেই ইসলামের যাবতীয় সৌন্দর্য ফুটে ওঠে । এজন্য ইসলামে আখলাকে হামিদাহ অর্জনের জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে ।
তাকওয়াঃ
তাকওয়া শব্দের অর্থ বিরত থাকা, বেঁচে থাকা, ভয় করা, নিজেকে রক্ষা করা। ব্যবহারিক অর্থে পরহেজগারি, খোদাভীতি, আত্মশুদ্ধি ইত্যাদি বোঝায়। ইসলামি পরিভাষায়, আল্লাহ তায়ালার ভয়ে যাবতীয় অন্যায়, অত্যাচার ও পাপকাজ থেকে বিরত থাকাকে তাকওয়া বলা হয় । অন্যকথায় সকল প্রকার পাপাচার থেকে নিজেকে রক্ষা করে কুরআন সুন্নাহ মোতাবেক জীবন পরিচালনা করাকে তাকওয়া বলা হয় । যিনি তাকওয়া অবলম্বন করেন তাঁকে বলা হয় মুত্তাকি ।
মহান আল্লাহকে ভয় করার অর্থ অত্যন্ত ব্যাপক । আল্লাহ তায়ালা আমাদের স্রষ্টা ও পালনকর্তা । তিনি আমাদের সবকিছু দেখেন, জানেন । তিনি শাস্তিদাতা ও মহাপরাক্রমশালী । হাশরের দিনে তিনি আমাদের সকল কাজের হিসাব নেবেন । অতঃপর পাপকাজের জন্য শাস্তি দেবেন । আল্লাহ-ভীতি হলো আল্লাহ তায়ালার সামনে জবাবদিহি করার ভয় । অতঃপর এরূপ অনুভূতি মনে ধারণ করে সকল পাপ থেকে বেঁচে থাকতে হয় । সকল প্রকার অন্যায়, অত্যাচার, অশ্লীল কথা-কাজ ও চিন্তাভাবনা থেকে বিরত থাকতে হয় । আল্লাহ তায়ালাকে ভয় করলে এসব পাপ থেকে সহজেই বেঁচে থাকা যায় । ফলে মুত্তাকিগণ পরকালে জান্নাতে প্রবেশ করবেন । আল্লাহ তায়ালা বলেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহর সামনে দণ্ডায়মান হওয়ার ভয় করবে ও কুপ্রবৃত্তি থেকে বেঁচে থাকবে, তার স্থান হবে জান্নাত ।” (সূরা আন-নাযিআত, আয়াত ৪০-৪১)
তাকওয়া একটি মহৎ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য । মানবজীবনে তাকওয়ার গুরুত্ব অপরিসীম । তাকওয়া মানুষকে ইহকালীন ও পরকালীন উভয় জীবনকেই সম্মান-মর্যাদা ও সফলতা দান করে । ইসলামি জীবন দর্শনে মানুষের মধ্যে সবচেয়ে মর্যাদাবান ব্যক্তি হলেন মুত্তাকিগণ । আল্লাহ তায়ালা বলেন,
إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللهِ أَتْقَكُمْ
অর্থ : “নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকট সবচেয়ে সম্মানিত সেই ব্যক্তি যে তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি তাকওয়াবান । ” (সূরা আল-হুজুরাত, আয়াত ১৩)
আল্লাহ তায়ালার নিকট তাকওয়ার মূল্য অত্যধিক। ধন-সম্পদ, শক্তি-ক্ষমতা, গাড়ি-বাড়ি থাকলেই মানুষ আল্লাহ তায়ালার নিকট মর্যাদা লাভ করতে পারে না । বরং যে ব্যক্তি তাকওয়া অবলম্বন করতে পারেন সেই আল্লাহ তায়ালার নিকট বেশি মর্যাদাবান । আল্লাহ তায়ালা তাঁকে ভালোবাসেন । আল্লাহ তায়ালা স্বয়ং বলেছেন-
إِنَّ اللهَ يُحِبُّ الْمُتَّقِينَ
অর্থ : “নিশ্চয়ই আল্লাহ মুত্তাকিদের ভালোবাসেন।” (সূরা আত্ তাওবা, আয়াত ৪)
পার্থিব জীবনে মুত্তাকিগণ আল্লাহ তায়ালার বহু নিয়ামত লাভ করে থাকেন । আল্লাহ তায়ালা তাকওয়াবানদের সর্বদা সাহায্য করেন । বিপদাপদ থেকে উদ্ধার করেন ও বরকতময় রিযিক দান করেন । আল্লাহ তায়ালা বলেন, “যে কেউ আল্লাহকে ভয় করে আল্লাহ তার পথ করে দেবেন এবং তাকে তার ধারণাতীত উৎস থেকে রিযিক দান করবেন।” (সূরা আত্-তালাক, আয়াত ২-৩)
পরকালেও তাকওয়াবানদের জন্য রয়েছে মহাপুরস্কার । আল্লাহ তায়ালা শেষ বিচারের দিন মুত্তাকিদের সকল পাপ ক্ষমা করে দেবেন এবং মহাসফলতা দান করবেন। আল-কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন, মুমিনগণ! যদি তোমরা তাকওয়া অবলম্বন কর (আল্লাহকে ভয় কর) তবে আল্লাহ তোমাদের ন্যায়- অন্যায় পার্থক্য করার শক্তি দেবেন, তোমাদের পাপ মোচন করবেন এবং তোমাদের ক্ষমা করবেন । আর আল্লাহ অতিশয় মঙ্গলময় ।” (সূরা আল-আনফাল, আয়াত ২৯)
إِنَّ لِلْمُتَّقِينَ مَفَازًا
আল্লাহ তায়ালা আরও বলেন, অর্থ : “নিশ্চয়ই মুত্তাকিগণের জন্য রয়েছে সফলতা ।” (সূরা আন্-নাবা, আয়াত ৩১)
প্রকৃতপক্ষে তাকওয়া মানব চরিত্রের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ স্বভাব। এর মাধ্যমে মানুষ সম্মান, মর্যাদা ও সফলতা লাভ করে।
নৈতিক জীবনে তাকওয়ার প্রভাবঃ
নৈতিক জীবন গঠনে ও নীতি-নৈতিকতা রক্ষায় তাকওয়ার প্রভাব অনস্বীকার্য । তাকওয়া সকল সৎগুণের মূল । ইসলামি নৈতিকতার মূল ভিত্তি হলো তাকওয়া । তাকওয়া মানুষকে মানবিক ও নৈতিক গুণাবলিতে উদ্বুদ্ধ করে । হারাম বর্জন করতে এবং হালাল গ্রহণ করতে প্রেরণা যোগায়। মুত্তাকি ব্যক্তি সদাসর্বদা আল্লাহ তায়ালাকে স্মরণ করেন । আল্লাহ তায়ালা সবকিছু দেখেন, শোনেন, জানেন, এ বিশ্বাস পোষণ করেন । ফলে তিনি কোনোরূপ অন্যায় ও অনৈতিক কাজ করতে পারেন না । কোনোরূপ অশ্লীল ও অশালীন কথা, কাজ ও চিন্তাভাবনা করতে পারেন না । কেননা তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন যে, পাপ যত গোপনেই করা হোক না কেন, আল্লাহ তায়ালা তা দেখেন ও জানেন । কোনোভাবেই আল্লাহ তায়ালাকে ফাঁকি দেওয়া সম্ভব নয় । ফলে তাকওয়াবান ব্যক্তি সকল কাজেই নীতি-নৈতিকতা অবলম্বন করেন এবং অনৈতিকতা ও অশ্লীলতা পরিহার করেন।
তাকওয়া মানুষের অন্তরকে পরিশুদ্ধ করে এবং সচ্চরিত্রবান হিসেবে গড়ে তোলে । সকল সৎ ও সুন্দর গুণ অনুশীলনে অনুপ্রাণিত করে । ফলে মুত্তাকিগণ সৎ ও সুন্দর গুণ অনুশীলনে অনুপ্রাণিত হন । অন্যদিকে যার মধ্যে তাকওয়া নেই, সে নিষ্ঠাবান ও সৎকর্মশীল হতে পারে না । সে নানা অন্যায় অত্যাচারে লিপ্ত থাকে । নৈতিক ও মানবিক আদর্শের পরোয়া করে না । ফলে তার দ্বারা সমাজে অনৈতিকতা ও অপরাধের প্রসার ঘটে।
বস্তুত তাকওয়া হলো মহৎ চারিত্রিক গুণ । নৈতিক চরিত্র গঠনে এর কোনো বিকল্প নেই । আমরা সকলেই তাকওয়াবান হওয়ার চেষ্টা করব।
ওয়াদা পালনঃ
ওয়াদাকে আরবি ভাষায় বলা হয় আল-আহ্দু (ii) । আল-আহ্দু এর শাব্দিক অর্থ- ওয়াদা, অঙ্গীকার, প্রতিশ্রুতি, চুক্তি, কাউকে কোনো কথা দেওয়া বা কোনো কাজ করার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হওয়া ইত্যাদি । ইসলামি পরিভাষায় কারও সাথে কোনোরূপ প্রতিশ্রুতি দিলে, অঙ্গীকার করলে বা কাউকে কোনো কথা দিলে তা যথাযথভাবে রক্ষা করাকে ওয়াদা পালন বলে।
ওয়াদা পালন আখলাকে হামিদাহর অন্যতম গুণ । মানবজীবনে এর গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম । ওয়াদা পালন সমাজে শান্তি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করে । যে ব্যক্তি ওয়াদা পালন করে তাকে সবাই ভালোবাসে । তার প্রতি সকলের আস্থা ও বিশ্বাস থাকে । সমাজে সে শ্রদ্ধা ও মর্যাদা লাভ করে । ইসলামি জীবন দর্শনে ওয়াদা পালন করা আবশ্যক । স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা মানুষকে ওয়াদা পূর্ণ করার জন্য নির্দেশ প্রদান করেছেন । তিনি বলেছেন, يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَوْفُوا بِالْعُقُودِ
অর্থ : “হে ইমানদারগণ! তোমরা অঙ্গীকারসমূহ পূর্ণ কর ।” (সূরা আল-মায়িদা, আয়াত ১) অন্য আরেকটি আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন,
وَاوْفُوا بِالْعَهْدِ : إِنَّ الْعَهْدَ كَانَ مَسْئُولًاه
অর্থ : “তোমরা প্রতিশ্রুতি পালন কর । নিশ্চয়ই প্রতিশ্রুতি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে।” (সূরা বনী ইসরাইল, আয়াত ৩৪)
প্রতিশ্রুতি ও ওয়াদা পালন করা অত্যাবশ্যক । হাশরের ময়দানে প্রতিশ্রুতির ব্যাপারে মানুষকে জবাবদিহি করতে হবে । যে ব্যক্তি দুনিয়াতে ওয়াদা পালন করে না, আখিরাতে সে শাস্তি ভোগ করবে ।
ওয়াদা পালন করা মুমিনের বৈশিষ্ট্য। সৎ ও নৈতিক গুণাবলির অধিকারী ব্যক্তিগণ সর্বদা ওয়াদা রক্ষা করে থাকেন । যে ব্যক্তি ওয়াদা পালন করে না সে পূর্ণাঙ্গ মুমিন ও দীনদার হতে পারে না। একটি হাদিসে মহানবি (স.) বলেছেন,
لَا دِينَ لِمَنْ لَّا عَهْدَ لَهُ -
অর্থ : “যে ব্যক্তি ওয়াদা পালন করে না, তার দীন নেই ।” (মুসনাদে আহমাদ)
আমাদের প্রিয়নবি (স.) সর্বদাই ওয়াদা পালন করেছেন । সাহাবি এবং আউলিয়া কেরামের জীবনী পর্যালোচনা করলেও আমরা দেখতে পাই যে, তাঁরা জীবনে কোনো ওয়াদা ভঙ্গ করেননি । কেননা ওয়াদা ভঙ্গ করা মুনাফিকের নিদর্শন । মুনাফিকরা ওয়াদা করলে তা পূর্ণ করে না । আল্লাহ তায়ালা মুমিনদের এরূপ না করার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন । কেননা মুমিন-মুসলমানের নিদর্শন হলো তারা ওয়াদা পালন করে । এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন,
ييهَا الَّذِينَ آمَنُوا لِمَ تَقُولُونَ مَا لَا تَفْعَلُونَ
অর্থ : “হে মুমিনগণ! তোমরা যা পালন করো না এমন কথা কেন বলো?” (সূরা আস- সাফ, আয়াত ২) সুতরাং কাউকে কোনো কথা দিলে তা যথাযথভাবে পালন করতে হবে, প্রতিশ্রুতি দিলে তা রক্ষা করতে হবে । প্রতিজ্ঞা করলে বা চুক্তি সম্পাদন করলে তা পূর্ণ করতে হবে । তাহলে আল্লাহ তায়ালা সন্তুষ্ট হবেন । দুনিয়া ও আখিরাতে শান্তি-সফলতা লাভ করা যাবে ।
সত্যবাদিতাঃ
সত্যবাদিতার আরবি প্রতিশব্দ আস-সিক । সাধারণভাবে সত্য কথা বলার অভ্যাসকে সত্যবাদিতা বলা হয় । অন্যকথায়, বাস্তব ও প্রকৃত ঘটনা বা বিষয় প্রকাশ করাকে সিদ্ক বলা হয় । অর্থাৎ কোনো ঘটনা বা বিষয় সম্পর্কে কোনোরূপ পরিবর্তন, পরিবর্ধন বা বিকৃতি ব্যতিরেকে হুবহু বা অবিকল বর্ণনা করাই 69 হলো সিদ্ক। যে ব্যক্তি সত্যবাদী তাকে বলা হয় সাদিক। আর মহাসত্যবাদীকে সিদ্দিক বলে ।
সত্যবাদিতার বিপরীত হলো মিথ্যাচার। কোনো ঘটনা বা বিষয়কে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হলো মিথ্যাচার। মিথ্যাচারকে আরবিতে আল কাযিব বলে । যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা বলে তাকে বলা হয় কাযিব আর চরম মিথ্যাবাদী হলো কায্যাব।
সত্যবাদিতা একটি মহৎ গুণ। মানবজীবনে এর গুরুত্ব অপরিসীম। কথা-বার্তা, কাজ-কর্ম ও আচার- আচরণে সত্যবাদিতা ও সততা অবলম্বন করলে মানুষ দুনিয়া ও আখিরাতে সফলতা লাভ করতে পারে । সদা সর্বদা সত্য, সুন্দর ও সঠিক কথা বলা আল্লাহ তায়ালার নির্দেশ । তিনি বলেন,
ياَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَقُولُوا قَوْلًا سَدِيدًا
অর্থ : “হে ইমানদারগণ, তোমরা আল্লাহকে ভয় কর ও সঠিক কথা বলো ।” (সূরা আল-আহযাব, আয়াত ৭০)
মহান আল্লাহতে বিশ্বাসী মুমিনগণের একটি অন্যতম নিদর্শন হলো তাঁরা সত্যবাদী । জীবনের সর্বাবস্থায় তাঁরা সততা ও সত্যবাদিতার চর্চা করেন । শুধু নিজে নিজে সত্য বলার চর্চা করলেই হবে না বরং সত্যবাদীদের সাথে সুসম্পর্ক থাকতে হবে। এতে সমাজে সার্বিকভাবে সত্য প্রতিষ্ঠিত হয় । এ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, “হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর ও সত্যবাদীদের সাথি হও।” (সূরা আত-তওবা, আয়াত ১১৯)
প্রকৃত মুমিন অবশ্যই সত্যবাদী হবেন। আমাদের প্রিয়নবি (স.) ছিলেন সত্যবাদিতার মূর্ত প্রতীক । জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে তিনি সততা ও সত্যবাদিতার চর্চা করেছেন । তাঁর সাথি হযরত আবু বকর (রা.) ও ছিলেন অত্যন্ত সত্যবাদী । তাই হযরত আবু বকর (রা.)-কে বলা হয় সিদ্দিক ।
যে ব্যক্তি সত্য কথা বলে তাকে সবাই ভালোবাসে, বিশ্বাস করে । পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি মিথ্যাবাদী তাকে কেউ ভালোবাসে না, সম্মান করে না। বরং সকলেই তাকে ঘৃণা করে । কেননা মিথ্যা বলা মহাপাপ । এটি সকল পাপের মূল মিথ্যাবাদীর উপর আল্লাহ তায়ালা চরম অসন্তুষ্ট ।
প্রভাব ও পরিণতিঃ
মানবজীবনে সত্যবাদিতার প্রভাব সীমাহীন। সত্যবাদিতা মানুষকে নৈতিক চরিত্র গঠনে সাহায্য করে । পাপ ও অশালীন কাজ থেকে রক্ষা করে । সত্যবাদী ব্যক্তি কোনোরূপ অন্যায় ও অত্যাচার করতে পারে না । একটি হাদিসে আমরা এর প্রমাণ পাই । হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, একদা জনৈক ব্যক্তি মহানবি (স.) এর নিকট এসে বলল, ‘আমি চুরি করি, মিথ্যা বলি এবং আরও অনেক খারাপ কাজ করি । সবগুলো খারাপ কাজ একসঙ্গে ত্যাগ করা আমার দ্বারা সম্ভব নয় । আপনি আমাকে যেকোনো একটি খারাপ কাজ ত্যাগ করতে নিৰ্দেশ দিন ।' মহানবি (স.) বললেন, “তুমি মিথ্যা বলা ছেড়ে দাও।” লোকটি বলল, এ তো খুব সহজ কাজ । মহানবি (স.)-এর কথামতো লোকটি মিথ্যা বলা ছেড়ে দিল । পরে দেখা গেল যে, মিথ্যা বলা ত্যাগ করায় তার পক্ষে আর কোনো খারাপ কাজ করা সম্ভব হলো না । সে সবগুলো খারাপ কাজ ছেড়ে দিল । কেননা সে ভাবল, কেউ তাকে অপরাধের কথা জিজ্ঞেস করলে সে মিথ্যা বলতে পারবে না । বরং স্বীকার করতে হবে । এতে সে লজ্জিত হবে ও শাস্তি ভোগ করবে । এভাবে শুধু মিথ্যা ত্যাগ করায় লোকটি সকল খারাপ কাজ থেকে মুক্তি পেল । সত্যবাদিতা এভাবেই মানুষকে উত্তম চরিত্রের অধিকারী হতে সাহায্য করে ।
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: মোঃ মামুন হাচান। মফস্বল সম্পাদক: শেখ মাহাবুব আলম। বার্তা সম্পাদক: এম এম হাচান। উপদেষ্টা হাবিবুর রহমান। সহকারী বার্তা সম্পাদক: চৌধুরী জুয়েল রানা। খুলনা অফিস: মুজগুন্নী খালিশপুর খুলনা। নড়াইল অফিস: নড়াগাতী থানা পূর্বপাড় বাজার, নড়াগাতী, নড়াইল যোগাযোগ: 01728-060690, 01933-200080, 01715422025 , ইমেইল: naragatirsangbad@gmail.com
Copyright © 2024 নড়াগাতীর সংবাদ. All rights reserved.