অনলাইন ডেস্ক
এলজিইডির সাবেক অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী কাজী মিজানুর রহমান। যিনি এখন নড়াইলের জমিদার হিসেবে পরিচিত।
সাবেক এই অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী কাজী মিজানুর রহমানের ১০ বছর আগেও উল্লেখ করার মতো তেমন সম্পদ ছিল না। তবে এলজিইডিতে লোভনীয় পদে বসার পর থেকেই তরতর করে বাড়তে থাকে তাঁর সম্পদ। বর্তমানে তিনি কার্যত নিজ এলাকা নড়াইলের জমিদার। সেখানে তাঁর ২০টি বাড়ি, ১৬০ একর জমি রয়েছে। পাশাপাশি রাজধানীতে আলিশান ফ্ল্যাট, তিনটি গাড়িসহ অঢেল সম্পদের মালিক তিনি। মিজান ও তাঁর গৃহিণী স্ত্রী দাবি করেছেন, তাদের প্রায় ২০ কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে। তবে সংশ্লিষ্টদের ধারণা, এ দম্পতির সম্পদের দাম এর কয়েক গুণ। যার প্রায় সবটাই অবৈধভাবে অর্জিত। মিজান অবশ্য দুর্নীতির অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) প্রাথমিকভাবে জানতে পেরেছে, নড়াইল শহরের আলাদাতপুর ও ভওয়াখালী এলাকায় তিনটি ও শোলপুর গ্রামে ১৭টি বাড়ি আছে মিজানের। এর মধ্যে ৬টি পাকা ও বাকিগুলো টিনশেড ও পাকা ওয়াল। ১০ একর জমির ওপর স্থাপিত এসব বাড়ির আনুমানিক মূল্য ১০ কোটি টাকা। এলাকায় প্রায় ৬০ একর জমির ওপর ১৩টি ছোট-বড় মাছের ঘের রয়েছে তাঁর। সেখানে বিদেশি কুকুর-বিড়াল, গরু-ছাগলসহ বিভিন্ন প্রজাতির কবুতর, হাঁস ও মুরগির খামার গড়ে তুলেছেন তিনি। একশ’ একরের বেশি বিলের জায়গা রয়েছে তাঁর, যার মূল্য প্রায় ১০ কোটি টাকা ও মাছের ঘেরের মূল্য ৬ কোটি টাকা। তিনটি গাড়ি রয়েছে তাঁর। জানা গেছে, খুলনা ও শ্বশুরবাড়ি সাতক্ষীরায়ও মিজানের বাড়ি আছে। তাঁর গৃহিণী স্ত্রী কাজী বনানী রহমানের নামে এসব সম্পত্তি।
মিজানের গ্রামের বাড়ি নড়াইল সদর উপজেলার শিঙ্গাশোলপুর ইউনিয়নের শোলপুর গ্রামে। জানা গেছে, ৩০ বছর আগে মাটির বেড়া দেওয়া একটি টিনের ঘর ছিল মিজানের বাবা কাজী কেনায়েতের। স্থানীয় বাজারে মুদি দোকানে কাজ করতেন তিনি। তাঁর মাত্র এক বিঘা জমি ছিল।
মিজানের দুই ভাই সেনাবাহিনীতে চাকুরি শেষে এখন ঢাকায় নিরাপত্তাকর্মী হিসেবে কাজ করছেন। আরেক ভাই এলাকার সম্পত্তি দেখাশোনা করেন। অভিযোগ রয়েছে, মিজান প্রায় ২০টি নিরীহ হিন্দু পরিবারকে ভয়ভীতি দেখিয়ে অল্পমূল্যে বাড়ি ও জমি কিনে নিয়েছেন।
জানা গেছে, ১৯৮৯ সালে এলজিইডির উপজেলা প্রকৌশলী হিসেবে চাকুরিতে যোগদান করেন মিজান। অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে অবসরে যান তিনি।
মিজান কীভাবে এত সম্পদের মালিক হলেন, তা নিয়ে একাধিকবার দুদকের অনুসন্ধান চললেও সেটি তিনি ধামা চাপা দেন। অবশেষে ফেঁসে যাচ্ছেন এই কর্মকর্তা। স্বামীর অবৈধ সম্পদ অর্জনের সহযোগী হওয়ায় তাঁর স্ত্রীও এখন মামলার জালে।
১৭ কোটি ৩৩ লাখ ৬৬ হাজার টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন ও ভোগদখলে রাখার অভিযোগে মিজান ও তাঁর স্ত্রীর নামে মামলা করেছে দুদক। সংস্থাটির যশোর সমন্বিত জেলা কার্যালয় তাদের দু’জনের বিরুদ্ধে এ মামলা হয়েছে।
মামলার অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে দুদকের সহকারী পরিচালক ও মামলার বাদী আলিয়াজ হোসেন বলেন, মিজানের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ যশোরসহ কয়েক জেলায়। সে জন্য এই মামলাটিতে দুদকের যশোর অফিসের কর্মকর্তারা প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদন দেবেন। সে অনুযায়ী পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। দুদক যশোরের উপসহকারী পরিচালক তাওহিদুল ইসলাম বলেন, মাত্র কয়েক দিন আগে অনুসন্ধানের জন্য তাঁর কাছে মামলার ফাইল গেছে। অনুসন্ধান করার পর বিস্তারিত জানাতে পারবেন।
মামলার এজাহারে বলা হয়, মিজানের স্ত্রী বনানীর নামে ৫৯টি দলিলে ১০ কোটি ৪৪ লাখ টাকার স্থাবর সম্পদ পাওয়া গেছে। সম্পদ বিবরণীতে বনানী ১৯ কোটি ৮১ লাখ টাকার সম্পদের ঘোষণা দেন। এর মধ্যে ১৭ কোটি ৩৩ লাখ টাকার সম্পদের কোনো বৈধ উৎস দেখাতে পারেননি।
এজাহারে আরও বলা হয়, বনানী একজন গৃহিণী ও স্বামীর ওপর নির্ভরশীল। তাঁর স্বামী মিজান তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী এবং ‘গুরুত্বপূর্ণ নগর অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প (২য় পর্যায়)’-এর ঢাকার স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের দায়িত্ব পালন করেন এবং সর্বশেষ খুলনায় এলজিইডির অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী থাকা অবস্থায় ২০২৩ সালের অক্টোবরে অবসরে যান।
অভিযোগ রয়েছে, এলজিইডির নগর অবকাঠামো উন্নয়নের পিডি থাকা অবস্থায় মিজানের বিরুদ্ধে প্রকল্পের কেনাকাটার অনিয়মের অভিযোগ ছিল। তাঁর বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ ও এলাকায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাড়ি দখলের অভিযোগ থাকলেও স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর তাঁর বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। দুদকে তাঁর বিরুদ্ধে একাধিকবার অভিযোগ জমা হলেও তদন্ত হয়নি। অবৈধ অর্থ আর ক্ষমতার জোর খাটিয়ে দুদকের অভিযোগ ধামচাপা দিয়েছেন তিনি।
জানা গেছে, ভুয়া বিল ও ভাউচার আর ঠিকাদারের সঙ্গে আঁতাত করে মিজান হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। প্রকল্পের মোট বরাদ্দের ৫ শতাংশ হারে কমিশন না দিলে কোনো অর্থছাড় দিতেন না তিনি। চেয়ারে ব্যবহারের জন্য একটি তোয়ালের দাম ৬ হাজার টাকা ধরে বিল করায় এলজিইডিতে তাঁকে অনেকেই ব্যঙ্গ করে তোয়ালে মিজান বলে ডাকতেন। মিজান বৃহত্তর বরিশাল অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প, পিরোজপুর জেলার চারটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সাইক্লোন শেল্টার প্রকল্প, জলবায়ু পরিবর্তন প্রকল্প, ঝালকাঠিতে গুরুত্বপূর্ণ পল্লী অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পসহ বেশ কয়েকটি প্রকল্পে পিডি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এসব উৎকোচ আদায়সহ নানা অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে।
এলজিইডি সূত্রে জানা যায়, পিডি থেকে পদোন্নতি পেয়ে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হলেও তিনি আগের পদে আরও দুই বছর থাকতে তদবির করেন। এ জন্য ১০ কোটি টাকা নিয়ে সে সময় মাঠে নামেন তিনি।
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী জানান, দুর্নীতির এত প্রমাণ থাকার পরও মিজান কীভাবে ছাড় পেয়েছেন, এটা তাদের কাছেও এক বড় রহস্য।
সূত্র জানায়, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ও নগর অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের পিডি থাকাকালে মিজানের দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত করেন দুদকের তৎকালীন সহকারী পরিচালক আবদুল ওয়াদুদ।
এ বিষয়ে তৎকালীন এলজিইডির প্রধান প্রকৌশলীর কাছে দুদকের সমন্বিত ঢাকা জেলা কার্যালয় হতে লিখিত এক পত্র দেওয়া হয়। অভিযোগের সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের দেশের ২৮৭টি পৌরসভায় বরাদ্দ দেওয়া অর্থের তালিকা, প্রকল্প পরিচালক হিসেবে মিজানের দায়িত্ব পালনের কার্যকাল, তিনি কোন কোন প্রকল্পের পরিচালক ছিলেন তার তালিকা চায় দুদক।
জানা গেছে, মিজান সে সময় দেশের বিভিন্ন পৌরসভার রাস্তা ও ড্রেন নির্মাণকাজের জন্য প্রায় ২৮ কোটি টাকা উৎকোচ গ্রহণ ও নিয়মবহির্ভূতভাবে একাধিক প্রকল্পের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। দুদকের কাছে আসা অভিযোগে বলা হয়, ২৮৭টি পৌরসভার রাস্তা ও ড্রেন নির্মাণ কাজের জন্য এলজিইডির আওতায় ৩ হাজার ৪০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়। এতে ‘ক’ শ্রেণির পৌরসভার জন্য ১৪ কোটি টাকা, ‘খ’ শ্রেণির পৌরসভার জন্য ১০ কোটি এবং ‘গ’ শ্রেণির পৌরসভার জন্য ৮ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। তবে যেসব পৌরসভা মিজানের চাহিদামতো ঘুষ দেয়, শুধু তাদেরই দরপত্র আহ্বানের অনুমতি দেওয়া হয়। অভিযোগে আরও উল্লেখ করা হয়, প্রতিটি পৌরসভার বরাদ্দ অনুমোদনের আগে ২ শতাংশ হারে ঘুষ গ্রহণ করেন মিজান। বরাদ্দের পর প্রতিটি পৌরসভার মেয়র, প্রকৌশলী ও সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মিজানের অফিসে ঘুষের টাকা পৌঁছে দেন।
মিজানের বেনামে একাধিক বাড়ি, ফ্ল্যাট ও প্লট রয়েছে এবং নিজ এলাকা নড়াইলে তাঁর আত্মীয় স্বজনের বিপুল সম্পদ কিনেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। বর্তমানে ধানমন্ডি ৩ নম্বর রোডে বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে বসবাস করছেন মিজান। ফ্ল্যাটটির বাজারমূল্য প্রায় ৫ কোটি টাকা বলে জানা গেছে।
অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে মিজান বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে যে অভিযোগে দুদকে যে মামলা করা হয়েছে, তা সঠিক নয়। দুদকের অনুসন্ধানে অভিযোগের প্রমাণ পাওয়া গেলে যে কোনো ধরনের শাস্তি মাথা পেতে নেব।’
সূত্র : সমকাল অনলাইন।